কথিত আছে কাছের বন্ধুকে ধার দিতে নেই, তাতে সম্পর্ক নষ্ট হয়।একথাটি কখনোই মানতে রাজি ছিলো না শোয়েব।কাছের বন্ধু টাকার অভাবে বিপদে পতিত হবে অথচ নিজের কাছে টাকা থাকা সত্বেও টাকা ধার দেয়া যাবে না,বন্ধুত্ব নষ্ট হবার অজুহাতে! এটা কেমন কথা? বন্ধুর বিপদে টাকা পয়সা ধার দিয়ে সহায়তা করতে হবে এরকম ধ্যানধারণা বদ্ধমূল ছিলো শোয়েবের অন্তরে।কিন্তু ইদানীং তার এই ধ্যানধারণা পাল্টে গেছে ,তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আকমলের আচরণে।আকমলের দুর্দিনে ত্রিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলো শোয়েব।কিন্তু দীর্ঘ একটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও টাকাটা ফেরৎ দিচ্ছে না আকমল।এই এক বছরে টাকা পরিশোধের বেশ কয়েকটি তারিখ দিয়েছিলো সে।কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে টাকাটা ফেরৎ দেয়নি।ব্যাপারটা শোয়েবকে খুব আহত করেছে।
আকমল আর শোয়েবের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো সেই বাল্যকাল থেকে।তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিলো চোখে পড়ার মতো।দু’জন বন্ধু একজনকে ছাড়া আরেকজন চলতেই পারতো না।দু’জন ছিলো একই মহল্লার বাসিন্দা।একসাথে মাছ ধরা,ফুটবল খেলা,কারো গাছের আম চুরি করা, বাবা-মা’ র চোখে ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া,একই স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়া সহ প্রতিটি কাজে দু’জন পাশাপাশি থাকতো।এলাকার সবাই তাদেরকে বলতো মানিকজোড়। পড়ালেখায় দু’জনেই ছিলো মাঝারি মানের। এস,এস,সি পরীক্ষায় দু’জনের কেউই এ প্লাস পায়নি।এইচ এস সি পরীক্ষায়ও দু’জনই সাধারণ মানের ফলাফল করে।পরবর্তীতে দু’জনেই একসাথে মাস্টার্স পাস করে একই কলেজ থেকে, যদিও দু’জন দুই সাবজেক্ট নিয়ে পড়ালেখা করেছে।কিন্তু তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধনটা ছিলো খুবই শক্তিশালী। বরং সময়ের সাথে সাথে সেটা যেনো আরও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।মাস্টার্স পরীক্ষার পরপর শোয়েব একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। তন্দ্রাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে।তন্দ্রার তখনও আঠারো বছর বয়স হয়নি।তন্দ্রার বাবা শোয়েবের নামে মামলা করে বসে।আকমল তখন ঢাকায় মেসে থেকে চাকরির চেষ্টা করছে।শোয়েব তন্দ্রাকে নিয়ে আকমলের মেসে এসে উঠে।আকমল তার এক ফুপাতো বোনের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আশ্রয় দেয় তাদেরকে।সেখানে তারা মাসখানেক ছিলো।পরবর্তীতে অবশ্য তন্দ্রার বাবা মেনে নেয় শোয়েবকে।
শোয়েব আর চাকরিবাকরির দিকে ঝুঁকেনি।সে ঢাকা শহরের মগবাজারে একটি হার্ডওয়্যারের দোকান খোলে বসে।তার ব্যবসাও মোটামুটি ভালো চলছিলো।ঐদিকে আকমল একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি নিয়েছে।চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে আকমলকে বিয়ে করিয়ে দেয় তার বাবা মা।সেই বিয়েতে খুব মজা করেছিলো শোয়েব আর তন্দ্রা।বিয়ের পর স্ত্রী তনুকে নিয়ে যাত্রাবাড়ি বাসা নেয় আকমল।যাত্রাবাড়ি থেকে মগবাজারের দূরত্ব বেশী হলেও মাঝেমধ্যেই দুই পরিবার মিলিত হতো, মজা করতো।
শোয়েব আর তন্দ্রার কোল জুড়ে একটি ছেলে সন্তান আসে তারও বছর তিনেক পর আকমল আর তনুর সংসারেও একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।
শেয়ার মার্কেটে বেশ বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছিলো আকমল।যার মধ্যে বেশ কিছু টাকা ধার করে বিনিয়োগ করেছিলো বেশী মুনাফার আশায়।পরবর্তীতে সেই টাকাটা আর উঠিয়ে আনতে পারেনি।এতো বড় অঙ্কের টাকার লোকসান গুণতে গিয়ে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়ে।যদিও সে চাকরি করে সেখানকার বেতন দিয়ে ধারের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়ে যায় আকমল।এই অবস্থা দেখে শোয়েবও খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ে।আকমলের এই দুর্দিনে হাজার ত্রিশেক টাকা ধার দেয়।
মাঝেমধ্যে আকমলকে ফোন দেয় শোয়েব।বেশীরভাগ সময় আকমল ফোন রিসিভ করতো না, এমনকি পরেও ব্যাক করতো না।আকমলের এরকম আচরণে আহত করতো শোয়েবকে। শোয়েব ভাবতো আকমল খুব চাপের মধ্যে আছে, হয়তো এখন টাকাটা ফেরৎ দিতে পারছে না বলে লজ্জায় ফোন রিসিভ করছে না।তারপরও শোয়েবের খারাপ লাগতো আকমলের এরকম বদলে যাওয়া দেখে।তন্দ্রা শোয়েবকে বললো এভাবে আর কতোদিন বন্ধুকে টাকা ধার দিয়ে রাখবে? এবার অন্তত টাকাটা ফেরৎ চাও।তন্দ্রার চাপে পড়ে আকমলের কাছে টাকা ফেরত চাইলে আকমল টাকা ফেরৎ দেয়ার তারিখ দেয়।কিন্তু টাকাটা ফেরৎ দিতে পারেনি।এভাবে একাধিক তারিখ দিয়েও টাকাটা ফেরৎ দিতে পারেনি আকমল।
লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখতে হয় শোয়েবের দোকান।যার ফলে আয় রোজগার নাই বললেই চলে। জমানো টাকায় চলতে হয়েছে,বাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে, ফলে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়ে যায় সে।এদিকে বাড়িতে তার দুই ভাই দেড়লাখ দিয়ে গরু কিনবে বলে জানিয়েছে ।শোয়েবের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চেয়েছে।শোয়েবও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে এতোগুলা টাকা কিভাবে দিবে? শোয়েবের ছেলে আবদার ধরেছে বড় গরু কেনার জন্য।শোয়েব তন্দ্রাকে বললো,এবার কোরবানি দেয়া সম্ভব হবে না।তন্দ্রা বললো তোমার নিজের টাকা বন্ধুর কাছে দিয়ে রেখেছো অথচ বলছো কোরবানি দিবে না,বন্ধুকে চাপ দাও টাকার জন্য।শোয়েব ভাবলো আকমলের অফিসে গিয়ে উঠবে।যেই ভাবা সেই কাজ।আকমলও টাকা দিতে রাজি হলো।পরদিন শুক্রবার আকমলের বাসায় যেতে বললো শোয়েবকে।
পরদিন শোয়েব আকমলের বাসায় গেলে আকমল বললো তোর টাকাটা আমার কাছে আছে, তোকে দেয়ার জন্য রেখেছি।কিন্তু আমার ছেলেটা খুব অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি।সেখানে টাকাটা আমার লাগবে।শোয়েব খুব উত্তেজিত হয়ে বললো এর আগেও কয়েকটি তারিখ দিয়ে তুই টাকাটা দিসনি , আজ আমি এতোসব বুঝি না, আমার টাকা ফেরৎ দে।আকমল বারবার অনুরোধ করা সত্বেও এতোটুকুও টলাতে পারেনি শোয়েবকে।শোয়েব ছিলো তার সিদ্ধান্তে অনড়।অগত্যা কোন উপায় না দেখে টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দিলো সে।
গরুর বাজার থেকে গরু নিযে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো শোয়েব।পথিমধ্যে তাদেরই এক বন্ধু সেলিমের নাম্বার থেকে ফোন আসলো শোয়েবের ফোনে।ফোন রিসিভ করতেই সেলিম জানালো একটা দুঃসংবাদ আছে,আকমল আজ সকালে স্টোক করে মারা গেছে।শোয়েবের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে , একেবারে থ মেরে গেছে।আকমলের ছেলের কি অবস্থা সেটা জানার কথা পর্যন্ত ভুলে গেলো।
শোয়েব বিষন্ন মনে গরু সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরছে।হঠাৎ গরুটার দিকে তাকিয়ে সে ভাবলো কি হতো এবছর কোরবানি না দিলে? গরু কোরবানি দিতে গিয়ে সে কিনা তার বন্ধুকেই কোরবানি দিয়ে দিলো!